ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় শহরে ১৭-২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জীববিজ্ঞান বিষয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সম্মানজনক প্রতিযোগিতার আসর আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড। সারা পৃথিবীর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত এবং কুড়ি বছরের নিচের শিক্ষার্থীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন দেশে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে বিশ্ববিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞান শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কমিটি। এবার ছিল আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের ২৭ তম আয়োজন। তবে বাংলাদেশ এবারই প্রথমবারের মতো অংশ নেয় এই প্রতিযোগিতায়। এতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা হলো সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের আইমান ওয়াদুদ, মাস্টারমাইন্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ওয়াসিক হাসান, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মাইশা মুনাওয়ারা প্রমি এবং স্কলাস্টিকার ওয়াসি রহমান চৌধুরী। প্রতিযোগিতা শেষে গত ২৪ জুলাই দেশে ফেরে বাংলাদেশ জাতীয় জীববিজ্ঞান দল। উল্লেখ্য, এবছর থেকে প্রতিযোগিতায় জাতীয় দল পাঠানোর পূর্বশর্ত হিসেবে গত বছর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত ২৬ তম আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো: শহীদুর রশীদ ভুঁইয়া।
আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ২০১৬ তে অংশ নেয় ৭২ টি দেশ। এর মধ্যে ৬৮ দেশ প্রতিযোগী শিক্ষার্থী প্রেরণ করে এবং চারটি দেশ থেকে অংশ নেন শুধু সেইসব দেশের প্রতিনিধিত্বকারী পর্যবেক্ষকবৃন্দ। বিশ্বের মোট ২৬৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে বাংলাদেশ দলের মাইশা এবং ওয়াসিক যথাক্রমে ৪৩.৪৮৯ এবং ৪০.৩৪৩ পয়েন্ট পেয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান করে নিতে করতে সক্ষম হয়। এজন্য তারা লাভ করে বিশেষ সম্মানসূচক ‘মেরিট’ পুরস্কার, যা ‘অনারেবল মেনশন’ নামেও পরিচিত। এ ধরণের মেধাভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশগ্রহণ করে মেধাতালিকায় স্থান পাওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এবং বাংলাদেশের জন্য নতুন। মাত্র দুই পয়েন্টের জন্য ব্রোঞ্জ পদক থেকে বঞ্চিত হয় বাংলাদেশের মাইশা। বাংলাদেশ দলের বাকি দুইজন প্রতিযোগী অল্প পয়েন্টের ব্যবধানে মেধাতালিকায় স্থান করে নিতে পারেনি। তবে উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে এবছর অংশ নেওয়া সকল প্রতিযোগীর মধ্যে ওয়াসি ছিল সর্বকনিষ্ঠ। বাংলাদেশের চার প্রতিযোগীর মধ্যে ব্যবহারিক অংশে সবচেয়ে ভালো করে আইমান। আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে দেশভিত্তিক র্যাঙ্কিঙে এবছর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, চীন ও তাইওয়ান। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা ভারত সম্মিলিত র্যাঙ্কিঙে রয়েছে নবম অবস্থানে। সম্মিলিত র্যাঙ্কিঙে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮ তম এবং সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয়। আগামী বছর ২৮ তম আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের আসর বসবে যুক্তরাজ্যে।
আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ২০১৬ তে জীববিজ্ঞান বিষয়ক পরীক্ষার মূল পর্ব সম্পন্ন হয় ছয়টি অংশে যার চারটি অংশ ব্যবহারিক ও দুটি অংশ তত্ত্বীয়। এছাড়াও শিক্ষার্থী ও জুরি-শিক্ষকবৃন্দের জন্য ছিল শিক্ষা সফর, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা বর্ণিল আয়োজন। এই বিশাল অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করে ভিয়েতনামের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং হ্যানয় ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের পরীক্ষার বিষয়বস্তু বা সিলেবাসে মোট সাতটি ক্ষেত্র রয়েছে: কোষতত্ত্ব ও প্রাণরসায়ন, উদ্ভিদ অঙ্গসংস্থান ও শারীরতত্ত্ব, প্রাণি অঙ্গসংস্থান ও শারীরতত্ত্ব, প্রাণি-আচরণবিদ্যা, জীনতত্ত্ব ও জৈব অভিব্যক্তি, বাস্তুবিদ্যা এবং বায়োসিস্টেমেটিক্স। ভালো ফলের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে এর প্রতিটি বিষয়ে ভাল ধারণা রাখতে হয়।
আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের জন্য প্রতিযোগী শিক্ষার্থী বাছাই প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধাপে সম্পন্ন হয়। বাছাই পর্বের শুরুতে এবার আয়োজন করা হয়েছিল দ্বিতীয় জাতীয় জীববিজ্ঞান উৎসবের। এবছর ৫ ফেব্রুয়ারি ‘লক্ষ্য এবার ভিয়েতনাম জয়’ স্লোগান সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বসেছিল দেশে জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় এ আসর। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল ছাড়াও সারা দেশের ৪৭ টি জেলা থেকে ৬০ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। এতে মোট ৬০ জন বিজয়ীকে পুরস্কৃত করা হয়। জাতীয় উৎসবে বিজয়ীদের নিয়ে জীববিজ্ঞান বিষয়ক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও চূড়ান্ত বাছাইয়ের জন্য ১১-১৩ মার্চ সাভারে অবস্থিত জাতীয় জীবপ্রযুক্তি ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় বায়োক্যাম্প। ক্যাম্পের মূল্যায়ন পরীক্ষায় চারজন শিক্ষার্থী অর্জন করে ‘মাস্টার ক্যাম্পার’ পুরস্কার। তারাই ১৭-২৪ জুলাই ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের হয়ে প্রতিযোগিতা করেছে।
আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ২০১৬ তে বাংলাদেশ দলে চার ক্ষুদে বিজ্ঞানীর সাথে দলনেতা ও জুরি হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাখহরি সরকার এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো: সামিউল আলম রাজীব। তাঁরা বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের আয়োজনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় জীববিজ্ঞান উৎসব এবং দ্বিতীয় জাতীয় বায়োক্যাম্পের মিডিয়া পার্টনার কালের কণ্ঠ, অনলাইন পার্টনার বিডিটাইমস ৩৬৫ এবং টেক পার্টনার ল্যাব বাংলা। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল শুভসংঘ। আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ২০১৬ তে অংশগ্রহণে বাংলাদেশ দলের স্পন্সর প্রাইম ব্যাংক, সোয়েটার মেকার্স এবং ফেয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড।
স্কলাস্টিকার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ওয়াসি রহমান চৌধুরী। মা তাসমিন জাহান একজন গৃহিনী এবং বাবা হাফিজুর রহমান চৌধুরী পেশায় প্রকৌশলী । মূলত মায়ের উৎসাহেই জাতীয় জীববিজ্ঞান উৎসবে অংশ নেওয়া। ইন্টারনেটের মাধ্যমে জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ও উৎসব সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে ওয়াসি। গত বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় জীববিজ্ঞান উৎসবে বিজয়ী হয়ে প্রাইম ব্যাংক – ব্রি প্রথম জাতীয় বায়োক্যাম্পে অংশ নিয়েছিল সে। ক্যাম্পেও জিতে নিয়েছিল মাস্টার ক্যাম্পার পুরস্কার। এবারও সেই ধারা বজায় রেখে দ্বিতীয় জাতীয় বায়োক্যাম্পের অন্যতম মাস্টার ক্যাম্পার নির্বাচিত হয় এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী। এবারের ক্যাম্পে একটু অসুস্থ হয়ে পড়লেও তা শেষতক বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি এই লড়াকু মেধাবীর জন্য। মাস্টার ক্যাম্পার হওয়ার সুবাদে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সারা বিশ্বের অন্যান্য ক্ষুদে বিজ্ঞানীর সাথে লড়ে ভিয়েতনাম থেকে ফিরেছে সে।
জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় শ্রেণির পাঠ্যবইটাই গুরুত্ব দিয়ে পড়েছে ওয়াসি। শুধু জীববিজ্ঞানে নয়, স্কুলে কুইজ এবং মিনি ম্যাথ অলিম্পিয়াডেও সে চ্যাম্পিয়ন। সেই সাথে পুরস্কার পেয়েছে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে। পড়াশোনা, অলিম্পিয়াড – এসবের বাইরেও নিজস্ব একটা জগত আছে তার। সেখানে সে আপন মনে ছবি আঁকে, পড়ে পছন্দের বইগুলো। অন্যদের জন্য তার আহ্বান, “যে বিষয় পড়ে তুমি আনন্দ পাও সেটা পড়ো।” ভাবুক প্রকৃতির স্বল্পভাষী এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী বড় হয়ে কী হবে সেটা যদিও এখনও ঠিক করেনি কিন্তু আমরা তার কাছে অসাধারণ কিছু একটা আশা করতেই পারি।
সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আইমান ওয়াদুদ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড সম্পর্কে প্রথম জানতে পারে তার স্কুলের জীববিজ্ঞান শিক্ষক অনিমেশ কুমার সাহার কাছ থেকে। পরবর্তীতে ইন্টারনেট থেকে এ ব্যাপারে আরও তথ্য পায় সে। আইমানের মা রাজিয়া সুলতানা একজন গৃহিনী এবং বাবা এবিএম শাকিল গনি পেশায় চিকিৎসক । তার মতে, তার সকল অর্জনের পেছনে মূখ্য ভূমিকা রেখেছে মা-বাবার সার্বিক সহযোগিতা। আইমানের অর্জন কিন্তু শুধু জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অন্যতম শীর্ষস্থান অধিকার করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সেন্ট যোসেফ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি থেকে এ পর্যন্ত একটানা প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে সে। অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়াটা তার জন্য স্বাভাবিকই বলতে হবে! কেবল স্কুল আর গৎবাঁধা পাঠ্যক্রমে আটকে নেই আই্মানের অর্জন। ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস প্রতিবছর স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট ফর স্কুলস’ নামে যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সেখানে ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে সে যথাক্রমে বিজ্ঞান এবং গণিত বিষয়ে শুধু দেশসেরাই হয়নি, ষোলটি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘রিজিওনাল টপার’ হিসেবে ছিনিয়ে নেয় স্বর্ণপদক। এছাড়াও তার ঝুলিতে আছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ‘বইপড়া কর্মসূচি’, বিজ্ঞান মেলা, গণিত উৎসব সহ অনেকগুলো প্রতিযোগিতায় অর্জিত পুরস্কার। ঘরের বাইরে ফুটবল আর ঘরের ভেতরে কম্পিউটার গেমস – দুটোতেই সমান পারদর্শী সে। ভালোবাসে গান শুনতে । দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে তার। শখ, দেশ-বিদেশের মুদ্রা সংগ্রহ করা।
জেএসসি পরীক্ষার কারণে জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের জন্য প্রস্তুতির সময় একটু কম পেলেও তা পুষিয়ে গেছে চিকিৎসক বাবার উৎসাহে। কেননা জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর বাবার সাথে আলোচনা করে সহজে বুঝে নিয়েছে আইমান। ইন্টারনেট সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারাটাও তার ভালো প্রস্তুতির একটা কারণ বলে মনে করে সে। বায়োক্যাম্পের সময় জাতীয় জীবপ্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের গবেষণাগারে ডিএনএ নিষ্কাশন প্রক্রিয়া নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, বাড়িয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ। হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সারির গবেষক হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখে আইমান। তবে শুধু ভালো ছাত্র বা ভালো গবেষক নয়, ভালো মানুষ হতে হবে – এমনটাই ভাবে সে। এজন্য দরকার মা-বাবা ও শিক্ষককে অনুসরণ করা। স্কুলের একাডেমিক ক্যালেন্ডার বজায় রেখে ক্যাম্প, ক্লাস, ল্যাব প্রভৃতি কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়াটা যদিও কষ্টকর ছিল, তবু ভিয়েতনামে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করাই আপাতত তার মূল লক্ষ্য।
মাস্টারমাইন্ড স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ওয়াসিক হাসান, ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া দূরে থাক, হয়তো আর একটু হলেই জাতীয় জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে পর্যন্ত অংশ নিতে পারতো না! ভাগ্য ভালো, তার স্কুলের মাশিয়াত ভাইয়ের কাছ থেকে এই অলিম্পিয়াডের ব্যাপারে প্রথম জানতে পারে সে এবং সেই বড়ভাইয়ের উৎসাহে নিবন্ধন করে একেবারে শেষ দিনে। ওয়াসিকের মা নাসিমা আক্তার একজন গৃহিনী এবং বাবা ওয়াকার হাসান পেশায় ব্যাংকার। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে সে বেশি উৎসাহ পায় তার মায়ের কাছ থেকে। অবশ্য পরিবার এবং স্কুলের সবাই তাকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবসময়ই সহযোগিতা করেছে, জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডও তার ব্যতিক্রম নয়। জীববিজ্ঞানের মতো গণিতেও সমান দক্ষ সে। মৌলিক গণিতে বিশ্বসেরা স্কোর করার পাশাপাশি ওয়াসিক ও-লেভেলে নয়টি বিষয়ে এ-স্টার পেয়েছে। এডেক্সেল হাই অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার স্পেলিং বি, গণিত অলিম্পিয়াড, ইনফর্মেটিক্স অলিম্পিয়াড প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় বরাবরই পুরস্কার পেয়ে আসছে সে। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধূলা করাটাও জরুরি। আর তাই ক্রিকেট এবং টেবিল টেনিস খেলতে পছন্দ করে ওয়াসিক। অবসরে ভালোবাসে গান গাইতে । ইংরেজি ছোটগল্প লিখে এরই মধ্যে হাত পাকিয়ে ফেলেছে এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী (এবং সাহিত্যিক!)। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ক্রিয়েটিভ রাইটিং কম্পিটিশন ২০১৩ তে প্রথম পুরস্কার লাভ তার প্রমাণ।
জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতির জন্য ওয়াসিক পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জীববিজ্ঞানের অন্যান্য বইয়ের সাহায্য নিয়েছে। বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে (www.bdbo.org) এ ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশনা থাকায় কোন বিষয়ের জন্য কী বই পড়তে হবে তা বোঝা সহজ হয়েছে। বায়োক্যাম্পে চমকপ্রদ সব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা তাকে জীববিজ্ঞান সম্পর্কে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। সেখানে এমন সব বিষয় নিয়ে হাতে-কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে যা কেবল গুটিকতক মানুষের হয়ে থাকে, তা-ও জীববিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট। ওয়াসিকের কাছে এসব অভিজ্ঞতা রীতিমতো ‘অবিশ্বাস্য’ লেগেছে। বড় হয়ে কী হতে চাও, এমন প্রশ্নের জবাবে ভালো মানুষ হওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছে সে। ছোটদের জন্য তার পরামর্শ, পড়াশুনার পাশাপাশি সব রকমের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। এতে করে কার কী ভালো লাগে, কে কোনটা ভালো পারবে – এসব ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস জন্মাবে, যা ভবিষ্যতে জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো নিতে সাহায্য করবে।
অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী মাইশা মুনাওয়ারা প্রমির জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে জীববিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আরও ভালো করে জানার আগ্রহই তাকে এতদূর আসতে সাহায্য করেছে বলে মনে করে সে। প্রমির বাবা হাবিবুর মিলা পেশায় ব্যবসায়ী এবং মা নাসরীন মোয়াজ্জেম গৃহিনী। শুধু জীববিজ্ঞান নয়, অন্য অনেক বিষয়ে তুখোড় এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী। ইংরেজি এবং বাংলাদেশ পাঠ বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ স্কোর অর্জন সহ ও-লেভেলে নয়টি বিষয়ে এ-স্টার পেয়েছে প্রমি। এছাড়া স্পেলিং বি, জাতীয় গণিত উৎসব, ডিএমআরসি বিজ্ঞান উৎসব, ন্যাশনাল ইংলিশ কার্নিভাল, ওআইএস হ্যান্ড রাইটিং কম্পিটিশন সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ফলাফলের দিক থেকে সবসময় উপরের দিকেই থাকে সে। ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস প্রতিবছর স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট ফর স্কুলস’ নামে যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সেখানে ২০১৫ সালে সে ছিনিয়ে নেয় স্বর্ণপদক। এছাড়াও ২০১৫ সালে SAT পরীক্ষায় সে ১৬০০ নম্বরের মধ্যে ১৫১০ অর্জন করেছে। প্রমির অবসর সময় কাটে বই পড়ে, লেখালেখি করে, ছবি এঁকে, নিটিং করে, সাইক্লিঙে বেরিয়ে, ড্রাইভিং শিখে কিংবা সাঁতার কেটে। পাশাপাশি, সমাজকে কিছু দেওয়ার তাগিদ থেকে সে বিভিন্ন ধরণের কমিউনিটি সার্ভিস এবং স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। মেধার লড়াইয়ে অগ্রগামী প্রমি ‘আসল’ লড়াইতেও পিছিয়ে নেই; কেননা আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে সে নিয়মিত তায়কোয়ান্দো চর্চা করে।
জাতীয় জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে শুধু নিজের স্কুলের পড়াটা পড়ে গিয়েছিল প্রমি। আশা ছিল না বিজয়ী হওয়ার। কিন্তু ঠিক যখনই ভেন্যু থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজের নাম শুনে হতবাক হয়ে যায় সে। যারা ভবিষ্যতে অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে ইচ্ছুক, তাদের উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য, পুরস্কার পাওয়া যাক বা না যাক বেশি বেশি করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে। তখন নিজের ভালোলাগা-মন্দলাগা দক্ষতা-অদক্ষতা ইত্যাদি সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস জন্মাবে। নিজেকে ভালো করে চিনতে শেখাটা ভবিষ্যতে ভালো কিছু করার জন্য খুব জরুরি। প্রমির ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে জাতিসংঘের হয়ে কাজ করার। দেশ ও পৃথিবীকে ভালো কিছু দিতে চায় সে। এতোকিছুর মাঝেও প্রমি দেশকে নিয়ে ভাবে। তার মতে, কোচিং ব্যবসা বন্ধ না হলে দেশের শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটবে না। কেননা কোচিং এক ধরণের পরনির্ভরশীলতা সৃষ্টি করে যা ওই শিক্ষার্থীকে আজীবনের জন্য সৃজনশীল চর্চার ক্ষেত্রে পঙ্গু করে দেয়। তাই কোচিং ব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া পথে অন্তরায়।