দ্বিতীয় জাতীয় বায়োক্যাম্প ২০১৬ : ক্ষুদে জীববিজ্ঞানীদের মিলনমেলা

IMG_2594

প্রথম দিন (১১ মার্চ ২০১৬)

দিনটার শুরুটাই যেন অন্যরকম। সকাল আটটা বাজার আগেই সাভারের গণস্বাস্থ্য পিএইচএ কনভেনশন সেন্টারে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সমাগম শুরু হয়ে গেছে। দ্বিতীয় জাতীয় বায়োক্যাম্প শুরু হতে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রতিযোগী বাছাইয়ের জন্য গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় জাতীয় জীববিজ্ঞান উৎসব। সেখানে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিতদের নিয়ে জীববিজ্ঞান বিষয়ক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও চূড়ান্ত বাছাইয়ের জন্য অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বিতীয় জাতীয় বায়োক্যাম্প। সেখান থেকেই প্রশিক্ষণোত্তর মূল্যায়ণের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে কারা ভিয়েতনামে এবছর বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের শর্তাবলী পূরণ সাপেক্ষে বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো জীববিজ্ঞানের সর্ববৃহৎ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে। সেই প্রত্যয় নিয়ে অভিভাবকদের বিদায় জানিয়ে একটুখানি ফ্রেশ হয়েই সবাই উঠে পড়লো নির্ধারিত বাসে। গন্তব্য ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজি। সেখানেই হবে মূল প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। সাড়ে আট কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস সেখানে পৌঁছালো। শুরু হলো মলিকুলার বায়োটেকনোলজি ল্যাবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচী। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজির বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এই ক্ষুদে জীববিজ্ঞানীরা হাতে-কলমে শিখলো কীভাবে কোষ থেকে ডিএনএ পৃথক করে তা নিয়ে নানা ধরণের গবেষণা করা যায়। এসব বিষয়ে এদেশে সাধারণত হাতেখড়ি হয় মাস্টার্স বা পিএইচডি করার সময়। আর ক্ষুদে জীববিজ্ঞানীরা সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই। কেননা আন্তর্জাতিক মেধাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে উজ্জ্বল করতে চাইলে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে থাকা চাই। প্রশিক্ষণের মাঝে মাঝে হাসি-গল্প-আড্ডা-গান আর খেলাধূলারও কমতি ছিল না। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। শেষ হয় সেদিনকার প্রশিক্ষণ। বাসে করে সবাই আবার ফিরে যায় গণস্বাস্থ্য পিএইচএ কনভেনশন সেন্টারে।

DSC_0065

দ্বিতীয় দিন (১২ মার্চ ২০১৬)

দ্বিতীয় দিনে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবাই যথারীতি বাসে উঠে পড়ে। গন্তব্য আবারও ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজি। এদিনের প্রশিক্ষণ শুরু হয় চিংড়ি ব্যবচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। এমনিতে চিংড়ি খেতে ভালোই লাগে কিন্তু তার ভেতরকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জটিলতা নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবি না। তাই চিংড়ি কেটে তার ভেতরটা আবিষ্কার করাটা শিক্ষার্থীদের জন্য অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা ছিল। তারপর উদ্ভিদবিজ্ঞানের পরীক্ষা। সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে গাছ অক্সিজেন উৎপাদন করে – এটা সবাই জানে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটি হাতে-কলমে পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা লাভ করে এসম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান। কতখানি অক্সিজেন কী সময়ে কেমন আলোতে উৎপাদিত হয় তা-ও মাপতে শেখে তারা। এছাড়াও পাতা-ফুল-মূল প্রভৃতি অংশের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করা হয়। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে সেগুলো কেমন দেখায় সেটাও শিক্ষার্থীদেরকে দেখানো হয়। শুধু তাই নয় অণুবীক্ষণে দেখার জন্য কীভাবে স্লাইড বানাতে হয় – তা শেখাও এই প্রশিক্ষণের অংশ ছিল। সবশেষে যে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তা জীববিজ্ঞানের অন্যতম আধুনিক এক প্রযুক্তি – বায়োইনফরমেটিক্স। এখানে জীবের ডিএনএ ও অন্যান্য অণুসমূহের গঠন এবং ক্রমবিন্যাসের তুলনা করে তাদের মধ্যে বিবর্তনগত সম্পর্ক নির্ণয় করা হয়। শিক্ষার্থীরা নিজ হাতে কম্পিউটারে অত্যাধুনিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির জীনের মধ্যে তুলনা করে দেখে। এই বিষয়টি হাতে-কলমে শেখার সুযোগ বাংলাদেশে খুব কম সংখ্যক গবেষকের হয়েছে। কিন্তু ক্যাম্পের এই ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা এত কম সময় ব্যাপারটা রপ্ত করে ফেলে যে প্রশিক্ষক নিজেই অবাক হয়ে যান। সারাদিনে প্রশিক্ষণের ধকল যেমন ছিল তেমনি ছিল আপন প্রতিভা মেলে ধরার সুযোগ। প্রশিক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে কেউ গেয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত, কেউ শোনায় কৌতুক আর কারও কণ্ঠে কবিতা। এভাবেই যবনিকা পড়ে দ্বিতীয় দিনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর। বাসে করে গণস্বাস্থ্য পিএইচএ কনভেনশন সেন্টারে ফিরে চলে সবাই।

DSC_0223

তৃতীয় দিন (১৩ মার্চ ২০১৬)

প্রশিক্ষণের শেষ দিনে শুরুতেই হয় মূল্যায়ণ পরীক্ষা। গত দুই দিনের প্রশিক্ষণের উপর ভিত্তি করে পরীক্ষাটি নেওয়া হয়। এই পরীক্ষার ফলের উপর নির্ভর করবে কারা এবার বাংলাদেশ দলের হয়ে জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক আসরে লড়াই করতে যাবে। পঞ্চাশ মিনিটের পরীক্ষা শেষে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজির বিজ্ঞানীরা এবং বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের একাডেমিক টিম একদিকে যখন পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে ব্যস্ত তখন অন্যদিক প্রশিক্ষণরত শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে বিশেষ সেমিনার – জীবপ্রযুক্তির বর্তমান ও ভবিষ্যত। এখানে জীবপ্রযুক্তির নানা দিক তুলে ধরেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজির মহাপরিচালক ড. মো: সলিমুল্লাহ এবং প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি ডিভিশনের প্রধান এবং সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার আবদুন নূর মো: ইফতেখারুল আলম। তারপর শুরু হয় সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক এবং কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল এবং সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের সভাপতি এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ড. মো: শহীদুর রশীদ ভুঁইয়া। অনুষ্ঠানটিতে রিসোর্স পারসন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব বায়োটেকনোলজির মহাপরিচালকসহ বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাবৃন্দ। অনুষ্ঠানে অতিথিরা শিক্ষার্থীদেরকে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে দেশ ও বিশ্বকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য অনুপ্রেরিত করেন। এরপর অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থীর হাতে প্রশিক্ষণ সনদ ও স্মারক ক্রেস্ট তুলে দেন অতিথিবৃন্দ। সবশেষে ‘মাস্টার ক্যাম্পার’ পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। অতিথিবৃন্দ ‘মাস্টার ক্যাম্পার’ দের হাতে বিজয়ী সনদ তুলে দেন এবং মেডেল পরিয়ে দেন। সভাপতি তারপর সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বিজয়ীরা হলো: সেন্ট যোসেফ স্কুল এন্ড কলেজের আয়মান ওয়াদুদ, মাস্টারমাইন্ডের ওয়াশিক হাসান, অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মাইশা এম. প্রমি এবং স্কলাস্টিকার ওয়াসি রহমান চৌধুরী। বিজয়ীরা আগামী ১৭-২৪ জুলাই ২০১৬ তে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের হয়ে প্রতিযোগিতা করবে।